আধুনিক বিশ্বের বিস্ময়ের নাম হলো ন্যানো টেকনোলজি বা ন্যানো প্রযুক্তি। বর্তমান যুগে এতো অভাবনীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে ন্যানো টেকনোলজি কারণে। আপনি হয়তো বিভিন্নভাবে ন্যানো টেকনোলজির নাম শুনেছেন। আসলে ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের পরিষ্কার ধারণা নাই। বৃহৎ আকারের অনেক জিনিসের ক্ষুদ্রতর হয়ে যাওয়ার পিছনে ন্যানো টেকনোলজির অবদান সবচেয়ে বেশি। ন্যানো টেকনোলজির সাথে অনেক কিছু সম্পর্কিত রয়েছে। আজকে আমার ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে সবকিছু জানব।
ন্যানো শব্দের অর্থ
ন্যানো (Nano) শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ। এটি এসেছে গ্রিক Nanos শব্দ থেকে যার অর্থ dwarf বা বামন। পরিমাপের একটি ক্ষুদ্র একক হলো ন্যানো। এক ন্যানোমিটার হচ্ছে একমিটারের একশত কোটিভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১ ন্যানোমিটার(1nm)=〖〗^(−) মিটার । যদি ইঞ্চির সাথে তুলনা করা যায় তাহলে ২৫,৪০০,০০০ ন্যানোমিটারে এক ইঞ্চি।
ন্যানো টেকনোলজি কি?
ন্যানো টেকনোলজি নামটি শুনেই হয়তো বুজতে পারছেন, এটি প্রযুক্তি সম্পর্কিত কিছু একটা হবে।
ন্যানো টেকনোলজি হল একটি বিজ্ঞানীয় এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্র, যেখানে সমস্ত বস্তুকে ন্যানোমিটার (ন্যানোমিটার হল 10^-9 মিটার) বা আরও ছোট্ট আকারে পরিমাপ করা হয়। ন্যানো টেকনোলজিকে বাংলায় ন্যানো প্রযুক্তি বলা হয়। অনেকেই ন্যানো টেকনোলজিকে সংক্ষেপে ন্যানোটেক নাম চেনে। ন্যানোটেকনোলজি হলো এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে ন্যানোমিটার স্কেলে একটি বস্তুকে নিপুণভাবে ব্যবহার করা যায় অর্থাৎ এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ধ্বংস বা সৃষ্টি করা যায়। এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে বর্তমানে ইলেকট্রনিক্স, মেডিকেল সরঞ্জাম এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি সাধারণত উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে। মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি বিভিন্নভাবে ব্যাবহৃত হচ্ছে। এই প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ ও সুবিধাজনক করার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ন্যানো টেকনোলজির উদাহরণ- ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহার করে সূর্য শক্তি ব্যবহার করে শুধুমাত্র ন্যানো রেজিস্টার এর মাধ্যমে বিশাল পরিমাণে শক্তি সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়াও ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার করে মেডিকেল ফিল্ডে নতুন উপকরণ উন্নয়ন করা হয় যা ক্যান্সার চিকিত্সার ক্ষেত্রে খুব উপযোগী হতে পারে।
ন্যানো টেকনোলজি জনক কে
ন্যানো টেকনোলজি জনক হিসাবে পরিচিত রিচার্ড ফেইনম্যান। তিনি একজন আমেরিকান পদার্থ বিজ্ঞানী। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখে রিচার্ড ফাইনম্যান এবং বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীরা মিলে আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে রিচার্ড ফাইনম্যান এই ন্যানো টেকনোলজির ধারনা সবার সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। সেদিন থেকেই শুরু হয় ন্যানো প্রযুক্তির। এজন্য রিচার্ড ফাইনম্যান কে ন্যানো টেকনোলজি জনক বলা হয়।
ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার
আধুনিক জগতে এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেখানে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যাবে না। দৈনন্দিন বাজারে প্রচলিত আছে এমন অনেক পণ্য এই ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে দিনদিন বাণিজ্যিক পণ্যর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ন্যানো টেকনোলজির কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যবহার নিচে আলোচনা করা হলো-
ইলেকট্রনিক্স শিল্পে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার
ট্রানজিষ্টর আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে পথযাত্রা শুরু হয়েছিল সেমিকন্ডাক্টর-এর। যেটি পরিমাপ শুরু হয় মাইক্রোটেকনোলজিতে। আর মাইক্রো টেকনোলজির পরবর্তী ধাপই হলো এই ন্যানো টেকনোলজি। এই প্রযুক্তি অগ্রগতির সাথে সাথে ছোট করার প্রচেষ্টা সফল হতে শুরু করে- রেডিও ,টেলিভিশন , কম্পিউটার ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে। ন্যানো টেকনোলজি কম্পিউটারের ক্ষেত্রে প্রসেসর উন্নয়নে তথা এর উচ্চ গতি, দীর্ঘ স্থায়িত্ব, কম শক্তি খরচ কম্পিউটারের মেমোরি, গতি দক্ষতা ইত্যাদি বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়।
ট্রানসিস্টর সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি, এটি সাধারণত ইলেকট্রনিক্স সুইচের সার্কিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে ইলেকট্রনিক সুইস এ ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহারের কারণে সুইচের এর আকার দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। বৈদ্যুতিক তারের রেজিস্ট্যান্স কমানোর জন্য ব্যাবহারিত হচ্ছে কার্বন ন্যানো টিউব , যার ফলে ইলেকট্রিক গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পাওয়ার লস কমানো হচ্ছে। ন্যানো ট্রানজিস্টর, ন্যানো ডায়োড, প্লাজমা ডিসপ্লে ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে ইলেকট্রনিক্স জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হচ্ছে এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিকশিত হচ্ছে। নূন্যতম বিদ্যুৎ খরচ, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির ওজন ও আকৃতি কমিয়ে এবং কার্যক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ন্যানো প্রযুক্তি দ্বারা তৈরি ব্যাটারি, ফুয়েল সেল, সোলার সেল ইত্যাদির মাধ্যমে সৌরশক্তিকে অধিকতর কাজে লাগানো যাবে।
চিকিৎসায় ন্যানো প্রযুক্তি
ন্যানো চিকিৎসা এখন আর মানুষের কল্পনার বিষয় নয়। আস্থে আস্থে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শুরু হচ্ছে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ছুরি বা কাঁচি দিয়ে অস্ত্রোপচারের দিন আস্তে আস্তে শেষ হয়ে আসছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজি কে বলা হয় ন্যানোমেডিসিন।
‘ন্যানোমেডিসিন’-এর প্রয়োগের বিষয়টি জনপ্রিয়তা শুরু হয়েছে। জীবকোষ অক্ষত ও কার্যকর রেখে রোগাক্রান্ত অংশের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। স্মার্ট ড্রাগ তৈরিতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। কেমোথেরাপি চিকিৎসার উন্নতি সাধন হচ্ছে ন্যানো প্রযুক্তি মাধ্যমে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি করার গবেষণা চলছে।
আপনি জেনে হয়তো অবাক হবেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি করার গবেষণা চলছে।কার্বন ন্যানোটিউব দ্বারা ন্যানো সুঁচ তৈরির গবেষণা চলছে । এই সুঁচের একপাশে থাকবে বিশেষ ধরণের প্রতিপ্রভ পদার্থ যার দ্বারা আলোকের সাহায্যে নির্দিষ্ট রোগাক্রান্ত কোষ নিশ্চিত করা যাবে। ফলে নির্দিষ্ট কোষে ওষুধ দেয়া হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা যাবে।
কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার-
কৃষিতে ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজির ব্যাবহারের কারণে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব। ফসলের উচ্ছিস্ট অংশ পুনরায় সার হিসেবে ব্যাবহার হচ্ছে। ফসলরের রোগ সনাক্ত করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী সার, ওষুধের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। খাদ্যের পচন রোধ কমিয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজি –
ন্যানো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যে নকশা করা হয়েছে-বেশ কিছু যুদ্ধাস্ত্রের। এ যুদ্ধাস্ত্রগুলো হবে স্বনিয়ন্ত্রিত। এগুলা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন মানুষের প্রয়োজন হবে না। অবাক করার বিষয় হচ্ছে এগুলার অকার হবে পোকা বা পাখির মতো ছোট। কিন্তু সেগুলোর ধ্বংস ক্ষমতা হবে মারাত্নক। এরা নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেই লক্ষ্য ঠিক করে অস্ত্র ক্ষেপণ করতে পারবে। এগুলা শুধুমাত্র কল্পনার বিষয় না। ন্যানো প্রযুক্তির কল্যাণে প্রচলিত অস্ত্রের পাশাপাশি খুব কম সময়েই তৈরি করা সম্ভব হবে এই যুদ্ধাস্ত্রর। প্রচলিত নিউক্লিয়ার মিসাইলের বদলে স্বনিয়ন্ত্রিত ন্যানো নিউক্লিয়ার মিসাইলও তৈরি হবে।
যানবাহন শিল্পে ন্যানো প্রযুক্তি
পলিমার ন্যানো কম্পোজিট ব্যাবহার করে যানবাহন এর ওজন দিন দিন হাল্কা করা হচ্ছে সাথে গাড়ির আকার অনেক ছোট করা হচ্ছে। যার কারণে জ্বালানি অপচয় কম হচ্ছে। তাছাড়া নির্মাণ খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো সম্ভব হয়। ন্যনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে যানবাহন শিল্পে তৈরি করা হচ্ছে গাড়ির জন্য উন্নতমানের ব্যাটারি যা , ওজনে হালকা, দীর্ঘ সময় চার্জ ধরে রাখতে পারে, দ্রুত চার্জ হয় এবং খুবই কার্যকরি।
ন্যানো টেকনোলজির সুবিধা
- ন্যানো টেকনোলজির ফলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সকল বস্তু টেকসই ,হালকা এবং অধিক উন্নত হচ্ছে।
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজি মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- কৃষি ক্ষেত্রে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
- খাদ্যদ্রব্য উন্নত প্যাকেজিং করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা হচ্ছে
- শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধন সম্ভব হচ্ছে।
- ইলেকট্রনিকস সামগ্রী আকারে ছোট করা সম্ভব হচ্ছে এবং টেকসই হচ্ছে।
- সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানব কল্যাণ সাধন হচ্ছে।
- ন্যানো টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের বিকল্প হিসেবে ব্যাবহৃত হচ্ছে।
ন্যানো টেকনোলজির অসুবিধা
- ন্যানো টেকনোলজি অতিরিক্ত ব্যয়বহুল, যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে।
- এই টেকনোলজি মানবদেহের জন্য হুমকিস্বরূপ।
- পারমাণবিক অস্ত্র সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে ,যা মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে
- মানুষের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা বাড়ছে।
- পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
শেষকথাঃ
ন্যানো টেকনোলজি আসার কারণে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। এই প্রযুক্তি সারা বিশ্বে এক বিষ্ময়কর পরিবর্তন আনছে। বিভিন্ন নতুন নতুন প্রযুক্তির সূচনা হচ্ছে , যা আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিচ্ছে। তবে সব জিনিসের ভালো এবং খারাপ দুটি দিক থাকে। ন্যানো টেকনোলজিরও কিছু খারাপ দিক রয়েছে। যা আমাদের জীবনের জন্য ক্ষতিকর। তবে আমরা যদি একটু সতর্ক থাকি তাহলে ন্যানো টেকনোলজির খারাপ বিষয়গুলো তেমন কোনো ক্ষতি করবে না।